banner
bangla-bar

 

কোভিড-১৯ মহামারী:
মানুষের পাশে থাকার জন্য বামপন্থীদের বলিষ্ঠ কর্মসূচি সূচনার এখনই সময়

ফ্রেড ম্যাগডফের সাক্ষাৎকার
সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ফারুক চৌধুরী।

ফ্রেড ম্যাগডফ ভারমন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ এবং মৃত্তিকা বিজ্ঞানের ইমেরিটাস অধ্যাপক। তিনি প্রতিবেশ, কৃষি এবং অর্থনীতির উপর বই লিখেছেন, লিখেছেন অনেক নিবন্ধ। তিনি নিয়মিত মান্থলি রিভিয়ু এ লিখে থাকেন। শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রামের সাথেও তিনি ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত। এ সাক্ষাৎকারে তিনি পুঁজিবাদ এবং কৃষির আলোকে করোনা ভাইরাস মহামারী সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। এ সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ফারুক চৌধুরী ২০২০ সালের ২রা এপ্রিল তারিখে। সাক্ষাৎকারটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছে কাউন্টার কারেন্টসে, ২০২০ সালের ১১ই এপ্রিল তারিখে (মূল সাক্ষাৎকারটির লিংক: https://countercurrents.org/2020/05/covid-19-pandemic-this-is-the-time-for-bold-programs-from-the-left-to-help-the-people-an-interview-with-fred-magdoff/ )। বাংলায় সাক্ষাৎকারটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছে নব গণগ্রন্থের ওয়েবসাইটে (nggbooks.wordpress.com), ২০২০ সালের ২৭শে জুন তারিখে। অনুবাদক: সামিয়া ইসলাম।

ফারুক চৌধুরী: দীর্ঘদিন ধরে আপনি পরিবেশ-প্রতিবেশ নিয়ে কথা বলছেন এবং বিশ্লেষণ করছেন। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা পরিবেশ-প্রতিবেশ যেভাবে ধ্বংস করছে, সে বিষয়ও স্থান পায় আপনার আলোচনা ও বিশ্লেষণে। বর্তমানে, করোনা ভাইরাস মহামারীর প্রেক্ষিতে এ পরিস্থিতিকে আপনি কীভাবে বিশ্লেষণ করবেন?

ফ্রেড ম্যাগডফ:  পুঁজিবাদী সম্পর্ক পৃথিবীজুড়ে বিস্তৃত হচ্ছে, বন উজাড় হচ্ছে, কৃষি জমি সম্প্রসারিত হচ্ছে। তাই পূর্বের তুলনায় প্রতিবেশ ব্যবস্থা এখন আরো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পূর্বে এর অবস্থা তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল ছিল। মানুষ থেকে আলাদাভাবে বেঁচে থাকার জন্যে বন্যপ্রাণীদের যে অঞ্চল, তা কমে যাওয়ার অর্থ হল বন্যপ্রাণী থেকে মানুষের মাঝে রোগ সংক্রমিত হবার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাওয়া। ধারণা করা হয় যে, বাদুড় থেকে সম্ভবত অন্য কোনো প্রাণীর মাধ্যমে কোভিড-১৯ এর জন্য দায়ী নতুন এই করোনা ভাইরাস মানুষের মাঝে এসেছে। এই পরিস্থিতিতে, মানুষের ভোগের জন্যে তৈরি করা বন্যপ্রাণীর বাজারের সাথে এ ঘটনার দৃশ্যতঃ সম্পর্ক রয়েছে। প্রকৃতিসহ সম্ভাব্য সব কিছুকেই পণ্যে পরিণত করা পুঁজিবাদের একটি দিক। ভবিষ্যতেও আরো নানা রকম রোগের, বিশেষত ব্যাকটেরিয়া ঘটিত রোগের সম্ভাবনা আছে। কারখানার মত করে চালিত খামারগুলো হতে পারে এ সব রোগের উৎপত্তিস্থল। এ সব খামারে গবাদি পশুদের গাদাগাদি করে রাখা হয়। এদেরকে রাখা হয় এমন পরিবেশে যা এদের বাসযোগ্য নয়। একই সাথে, তাদেরকে নিয়মিতভাবে খাওয়ানো হয় অ্যান্টিবায়োটিক। এ প্রক্রিয়া এমন সব ব্যাকটেরিয়া ব্যাপকভাবে তৈরি করেছে, যেগুলো সচরাচর ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিকগুলোকে প্রতিহত করতে পারে। ঔষধ কোম্পানিগুলো মানুষ অথবা খামারের পশুর (বা গৃহপালিত পশুর) ক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্যে অন্যান্য ঔষধের মতই যত বেশি সম্ভব তাদের অ্যান্টিবায়োটিকগুলো বিক্রির চেষ্টা করতে থাকে। এভাবে মুনাফার উদ্দেশ্যই অ্যান্টিবায়োটিকের অতিরিক্ত ব্যবহার এবং অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী নতুন প্রজাতির ব্যাকটেরিয়ার ক্রমবর্ধমান সমস্যা তৈরি করে।

ফারুক চৌধুরী: পুঁজিবাদ সম্পর্কে প্রত্যেক পরিবেশবাদীর যা জানা প্রয়োজন - বইতে আপনি এবং মান্থলি রিভিউর সম্পাদক জন বেলামি ফস্টার পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে চিহ্নিত করে বলেছেন যে, এ ব্যবস্থার দানবীয় থাবা আমাদের গ্রহের পরিবেশ-প্রতিবেশকে ধ্বংস করে দিচ্ছে এবং এই গ্রহের সমস্ত প্রাণকে হুমকির মুখে ফেলছে। করোনা ভাইরাস মহামারী প্রকৃতি, স্বাস্থ্যসেবা, অর্থনীতি, বিজ্ঞান, বন ও বন্যপ্রাণীকে নিয়ে গড়ে ওঠা প্রকৃতিসহ জীবন সংশ্লিষ্ট সকল ক্ষেত্রে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ধ্বংসাত্মক ভূমিকা দেখিয়ে দিচ্ছে। এই ব্যবস্থা জীবনের মৌলিক প্রাথমিক চাহিদাগুলোকে অস্বীকার করে। এখন, মানুষ জীবন দিয়ে এর মূল্য দিচ্ছে। এত প্রাণহানি, যা মহাদেশ থেকে মহাদেশে বিস্তৃত ও গণহত্যার সামিল। আজ মহামারীর এমন বাস্তবতাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?    

ফ্রেড ম্যাগডফ: পুঁজিবাদ বহু দিক থেকে ব্যর্থ হচ্ছে। এই মহামারী তারই একটি উদাহরণ। এ সব ব্যর্থতার একটি হচ্ছে, স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থার ব্যর্থতা, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ব্যর্থতা। এ বিষয়টিই বলেছিলেন প্রয়াত জীববিজ্ঞানী রিচার্ড লেভিনস: “স্বাস্থ্যসেবা একটি পণ্য, আর স্বাস্থ্য হচ্ছে এ পণ্যের উপজাত।” যুক্তরাষ্ট্রে হাসপাতালগুলোতে রোগীদের জন্যে রয়েছে তুলনামূলকভাবে অল্প সংখ্যক শয্যার ব্যবস্থা, সাধারণ অবস্থায় প্রতি ১,০০০ জন মানুষের জন্য ৩টিরও কম, যা দ্বারা হাসপাতালগুলো স্বাভাবিক অবস্থায় কোনোভাবে কাজ চালিয়ে নিতে পারে। স্বাস্থ্যসেবা মজুদ ছিল অপর্যাপ্ত। যদিও সরকার কয়েক বছর আগে স্বল্প মূল্যের হাজার হাজার ভেন্টিলেটর ক্রয় করার একটি ব্যবস্থা চালু করেছিল। শ্বসনতন্ত্রে সংক্রমণ ঘটানো এই রোগের সাথে পেরে ওঠার জন্যে বর্তমানে অনেক ভেন্টিলেটর প্রয়োজন। কিন্তু আয়োজনটি ব্যর্থ হয়েছিল। কেননা, প্রাথমিক চুক্তিতে যুক্ত কোম্পানিগুলোকে বড় কোম্পানিগুলো কিনে নিয়েছিল। এই কিনে নেয়া হচ্ছে একচেটিয়া করারই প্রক্রিয়া। এরপর বড় কোম্পানিগুলো স্বল্প লাভের পণ্য হিসেবে এসব ভেন্টিলেটরে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এমনকি আজ অবধি, সরকার প্রয়োজনীয় উৎপাদন ক্ষমতা গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে, সেটি শুধু ভেন্টিলেটরের ক্ষেত্রেই নয়, স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষার জন্যে মাস্ক ও গাউনের (ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী) ক্ষেত্রেও। আক্ষরিক অর্থেই শত শত স্বাস্থ্যকর্মী পর্যাপ্ত সুরক্ষা সামগ্রীর অভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। সব চেয়ে বেশি প্রয়োজন যেখানে, সে জায়গায় উপকরণগুলো আগে পৌঁছানোর কোনো সুসামঞ্জস্যপূর্ণ বিতরণ পদ্ধতি আজ পর্যন্ত নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এখন আমরা যে পরিস্থিতির মুখোমুখি, তার জন্যে পুঁজিবাদ, বিভিন্ন সরকারি সংস্থার ভুলগুলো এবং রাষ্ট্রপতিসহ সরকারের সর্বোচ্চ স্তরের চরম অদক্ষতাই দায়ী। আক্ষরিকভাবেই মাসের পর মাস নষ্ট হয়েছিল। সঙ্কটের এই সময়ে যে পরিমাণ সাড়া দেয়া উচিত ছিল, শুরু থেকেই তাতে ছিল ঘাটতি, মূলত কোথায় এটি ছড়িয়েছিল তা খুঁজে বের করার ক্ষেত্রে এবং কোভিড-১৯ পজিটিভ রোগীর সংস্পর্শে এসেছিলেন, এমন লোককে চিহ্নিত করার সক্ষমতা তৈরি করতে দেরী করায় এই অবস্থা তৈরি হয়। আজ অবধি, ভাইরাসটি চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে পরীক্ষা করার পরিমাণ অপর্যাপ্ত, যা এই রোগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা আরো কঠিন করে তুলছে। কেবল পরীক্ষার ক্ষেত্রে এই বিলম্বের ফলে হাজার হাজার মানুষ, সম্ভবত লক্ষ মানুষকে প্রাণ দিতে হবে। অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে আক্রান্ত হওয়া মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। কোভিড-১৯ এর ফলে চীনে যতজন মানুষের মৃত্যু হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে মৃতের সংখ্যা তা অতিক্রম করেছে। এবং এই অবস্থা খুব দ্রুত পরিবর্তিত না হলে, যুক্তরাষ্ট্রে মৃতের সংখ্যা অন্য যে কোনো দেশের মৃতের সংখ্যাকে ছাড়িয়ে যাবে। এটি অনুমান করা যায় যে, পরিস্থিতির যদি সব চেয়ে কম অবনতিও ঘটে, তা হলেও যুক্তরাষ্ট্রে হয়তো এক লক্ষ থেকে দুই লক্ষ মানুষ মারা যাবেন। এবং পৃথিবীর সব চেয়ে ধনী ও ক্ষমতাধর একটি দেশের বাস্তবতা এটি। এমন ঘটনা কেবল সে দেশেই ঘটতে পারে, যেখানে মানুষের স্বাস্থ্যের আগে গুরুত্ব পায় মুনাফা এবং মহামারী চলাকালে জনসাধারণকে রক্ষা করতে যা করা প্রয়োজন, সরকার তা করতে অনিচ্ছুক।

ফারুক চৌধুরী: এই মহামারীতে বিশ্ব মানবতা যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছে, তার কোনো নজির নেই। এর সম্পূর্ণ ফলাফল এখনো অজানা। মৃত্যু এবং ব্যাধির এই আধিক্য থেকে, জীবনের প্রতি এই পদ্ধতির উদাসীনতা থেকে রক্ষা পেতে কোথা থেকে শুরু করতে হবে?

ফ্রেড ম্যাগডফ: রোগাক্রান্তদের চিকিৎসায় কার্যকর একটি প্রতিষেধক (ভ্যাকসিন) ও ঔষধ ব্যাপকভাবে প্রয়োগের পর সমাজ কী রূপ ধারণ করবে, তা এখনো পুরোপুরি পরিষ্কার নয়। মহামারীটি অবশ্যই জনসাধারণের উপর, বিশেষ করে, তাদের উপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলবে, যারা এই রোগে পরিবারের সদস্য ও বন্ধুদের হারিয়েছেন। নিঃসন্দেহে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসবে। বড় ও শক্তিশালী কোম্পানিগুলো আরও বড়, আরো ক্ষমতাধর হয়ে উঠবে, অপরদিকে অন্যরা হয়ে পড়বে দেউলিয়া। ‘স্বাভাবিক জীবনে’ ফিরে যেতে মানুষের দীর্ঘ সময় লাগবে। তবে মনে রাখতে হবে যে, এই ‘স্বাভাবিক জীবন’ অনেক মানুষের ক্ষেত্রেই ভালো ছিল না। তাদের ঋণের কী হবে, যে ঋণ তারা শোধ করতে পারবেন না? বন্ধকের টাকা দিতে না পারায় যাদের বাসা থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে, সে সব মানুষের কী হবে? জনগণের টিকে থাকা এবং বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার সাহায্যার্থে বলিষ্ঠ নানা কর্মসূচি নিয়ে বামপন্থীদের এগিয়ে আসার এখনই সময়। বামপন্থীদের উচিত অভাবগ্রস্তদের খাদ্য নিরাপত্তা বৃদ্ধিতে, সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার জন্যে এবং অন্যান্য সামাজিক কর্মসূচি, যেমন: অসুস্থতায় সবেতন ছুটি, ইত্যাদি বিষয়ে কর্মসূচি গ্রহণে জোর চেষ্টা চালানো। অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার শুরু হওয়ার সাথে সাথে গৃহহীনদের জন্যে গৃহ তৈরি এবং জরাজীর্ণ বিদ্যালয়সমূহ সংস্কারের সাথে সাথে অন্যান্য সামাজিক প্রয়োজনে, যেমন: কোনো জরাজীর্ণ অবকাঠামোর অন্যান্য অংশ মেরামতের কাজে মানুষদের নিয়োজিত করতে হবে।

ফারুক চৌধুরী: বর্তমানের এই জ্বলন্ত সমস্যাগুলোর উপর আলোকপাত করার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ।

অনুবাদক: সামিয়া ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের একজন শিক্ষার্থী।

Back to Home Page

Frontier
Jul 2, 2020


Omar Raad Chowdhury omar.raad.chowdhury@gmail.com

Your Comment if any